অধিকার ডেস্ক :: কিশোর ক্ষুদিরাম বসু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে গেছেন ব্রিটিশদের হাত থেকে নিজের জন্মভূমি ভারতকে মুক্ত করতে, মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার পতাকা উড়াতে। এ জন্য ফাঁসির দঁড়িকেও তিনি করেছেন তুচ্ছ জ্ঞান, হাসতে হাসতে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন মৃত্যুকে।
আজ থেকে ১১১ বছর আগের এমনই একটা দিনে ফাঁসির মঞ্চে আত্মদান করতে হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসুকে। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট, সময় তখন ভোর ৫টা। ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন। যারা ফাঁসিতে ঝুলাবেন তাঁরাও প্রস্তুত।লোহার গরাদ দেওয়া গেটটি তখনো বন্ধ। হঠ্যাৎ গেটটি খুলে গেল। সেই গেট পেরিয়ে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসছেন একটি কিশোর, তিনি আর কেউ নন, ক্ষুদিরাম।
মেধাবী এই দেশপ্রেমিক অন্যায়কে মেনে নিতে পারেননি কখনো। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় লেখা পড়াতেও বেশি দূর এগোতে পারেননি বোনের কাছে বড় হওয়া ক্ষুদিরাম। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় এই কিশোর ১৯০৩ সালে অষ্টম শ্রেণীতে থাকাকালীন বাদ দেন পড়াশোনা। তখন থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে তাঁর দুঃসাহসিকতা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে তাঁর কণ্ঠ।
১৯০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী নেতা শ্রী অরবিন্দ এবং সিস্টার নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করে জনসম্মুখে বক্তব্য দেন এবং বিপ্লবী দলগুলোর সাথে গোপন পরিকল্পনা করেন। তখন তরুণ ছাত্র ক্ষুদিরাম বিপ্লবে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত হন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুদিরাম তাঁর বোন অপরূপার স্বামী অমৃতার সাথে তামলুক শহর থেকে মেদিনীপুরে চলে যান। সেখানে বিপ্লবীদের একটি নবগঠিত আখড়ায় যোগ দেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ক্ষুদিরাম তাঁর গুণাবলীর জন্য সবার চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন।
‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি
আমি হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’
তাঁকে স্মরণ করে অবিস্মরণীয় এ গান রচিত হয়েছিলো, তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে শত বছর ধরে গ্রাম-শহর, পথে-প্রান্তরে কোটি কোটি মানুষের কন্ঠে এ গান পরম মমতায় উচ্চারিত হচ্ছে।
অত্যাচারী বৃটিশ রাজপুরুষ, কোলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে বিপ্লবীদের গোপন আদালতে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছিলো। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিপ্লবী দায়িত্ব পেয়েছিলেন মেদেনিপুরের ছেলে ক্ষুদিরাম বসু এবং রংপুরের ছেলে প্রফুল্ল চাকি। কোলকাতা থেকে বদলি হয়ে বিহারের মজঃফরপুর গিয়েছিলেন কুখ্যাত কিংসফোর্ড। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকিও তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার জন্যে হাজির হয়েছিলেন মজঃফরপুরে।
১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় মজঃফরপুরের ইউরোপিয়ান ক্লাবে তাস খেলে, দুটো আলাদা গাড়িতে বাংলোতে ফিরছিলেন সস্ত্রীক কিংসফোর্ড ও উকিল কেনেডির স্ত্রী-কন্যা। রাতের অন্ধকারে ভুল করে সামনের গাড়িকে কিংসফোর্ডের গাড়ি মনে করে শক্তিশালী বোমা ছুড়েছিলেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি। ভুলবশতঃ মারা পড়লেন কেনেডিপত্নি ও কন্যা। বেঁচে গেলেন কিংসফোর্ড। ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদে পালাতে পারলেও, পরদিন দুজনই ধরা পড়েন আলাদা জায়গায়। পুলিশের এসআই নন্দলালের ষড়যন্ত্রে প্রফুল্ল চাকি ধরা পড়লেও, পুলিশ তাঁকে জীবন্ত অবস্থায় গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে পারেনি। পুলিশের হাত থেকে এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে দৌঁড়ে কিছুদূর গিয়ে নিজের সাথে থাকা পিস্তলের গুলিতে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন প্রফুল্ল চাকি। প্রাণহীন চাকির মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়েছিলো। অবশ্য, লোভী নন্দলালও কিছুদিনের মধ্যে বিপ্লবীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
ক্লান্ত ক্ষুদিরামও পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন দুটো পিস্তলসহ। অপ্রস্তুত ক্ষুদিরাম পিস্তল ব্যবহারের সুযোগ পাননি । বৃটিশ বিচারালয়ে ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ হয়েছিলো। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট মজঃফরপুর কারাগারে নির্ভীক চিত্তে ফাঁসির মঞ্চে উঠে আত্মদানের বিরল গৌরব অর্জন করেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু। আত্মদানের ১১১তম বার্ষিকীতে অগ্নিশিশু ক্ষুদিরামকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি!