তুহিন কান্তি ধর ::
কমরেড পুরঞ্জয় চক্রবর্তী বাবলা সিলেটের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের এক বহুল পরিচিত নাম। তিনি ‘বাবলা’ নামেই অধিক পরিচিত। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় সুনিল কর এর পরিচালনায় “নরেনের স্বপ্ন” নামক একটি নাটকে অভিনয় করার মাধ্যমে তাঁর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ শুরু। তারপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দলীয় গণসংগীতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। একই সাথে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। অল্প বয়সে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক বাম ধারার লড়াকু ছাত্র গণসংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন এর সাথে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। সামরিক শাসনের যাতাকলে পিষ্ট নিপীড়নমূলক সেই বিরূপ পরিস্থিতিতেও অন্ত্যন্ত সাহসীকতার সাথে সাংস্কৃতিক কাজকর্মের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তিনি চালিয়ে যান।
১৯৫৩ সালের ১৮ মার্চ সিলেট নগরীর আগপাড়া (রায়নগর পয়েন্টের নিকটে) এলাকায় নিজ বাড়িতে পুরঞ্জয় চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বিজয় ভূষণ চক্রবর্তী ও মাতার নাম সরজুবালা চক্রবর্তী। মিরাবাজারস্থ কিশোরী মোহন পাঠশালায় ১৯৫৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। প্রাথমিক পর্ব শেষ করে ১৯৬৪ সালে তিনি রাজা জি সি হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৬৯ সালে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে মদনমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা পাশ করেন। অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু চঞ্চল প্রকৃতির পুরঞ্জয় চক্রবর্তী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজনৈতিক কাজকর্মেও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রগতিশীল বিভিন্ন ছাত্র-গণআন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসে নানা কাজের সাথে যুক্ত হন। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বিশেষ গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়ে ৪ নং সেক্টরে বীরত্বের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বিজয়ীর বেশে নিজ ঘরে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন এবং পার্টির সিলেট জেলা কমিটির সদস্যসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। আজীবন পার্টির সদস্য ছিলেন এবং জীবনের শেষ দিকে তিনি সিপিবি শাপরান থানা শাখার সাথে যুক্ত থেকেছেন। যদিও দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থতায় ভোগছিলেন, তবুও পার্টির প্রতি দায়িত্ববোধের বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলো না তাঁর।
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে দীক্ষিত কমরেড পুরঞ্জয় চক্রবর্তী খুবই কর্মঠ, সৃজনশীল, প্রতিভাবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন এবং আদর্শিকভাবে নীতিনিষ্ট অবস্থানে থেকে সততা ও দক্ষতার সাথে পার্টি কর্তৃক আরোপিত সকল দায়িত্ব সুসম্পন্ন করতেন। সকলের প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব কমরেড পুরঞ্জয় সর্বস্তরের মানুষের সাথে অতি সহজে মিশতে পারতেন, আপন করে নিতে পারতেন দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে। তাইতো সবার কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় ‘বাবলাদা’। উচ্চ গড়নের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও সর্বদা আশাবাদী হাসিখুশি বাবলাদা সকল কাজকেই সিরিয়াসলি নিতেন। পার্টি সদস্যদের সুখ-দুখের খবর রাখতেন, পার্টি কর্মীদের বাসায় যেয়ে যোগাযোগ রাখতেন; আবার কাজের বেলায় কারো গাফিলতি বা শৈথিল্য দৃষ্টিগোচর হলে কড়া ধমকও দিতেন। এতে সেই কর্মী প্রথমে ভড়কে গেলেও পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভুলগুলো শোধরে নিতো। এতে করে কাজটিও যেমন সঠিকভাবে সম্পন্ন হতো, তেমনি তাঁর উপর শ্রদ্ধাবোধও বেড়ে যেতো। এটা আমার নিজের বেলায়ও একাধিকবার ঘটেছে। তাঁর জীবনের শেষদিকে (২০১৯ সালে) একবার আমি খুব বেশি অসুস্থ হয়ে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছি, সেই সময় তিনিও খুব অসুস্থ ছিলেন। আমি সেটা জানতাম। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যার পর দেখি তিনি আমার বাসায় চলে এসেছেন আমাকে দেখতে! একজন অসুস্থ ও বয়স্ক কমরেড নিজের কথা চিন্তা না করে সাহসে ভর করে আরেকজন অসুস্থ পার্টি কর্মীকে দেখতে তার বাসায় একা একা চলে এসেছেন- এ যেনো আমার কল্পনারও অতীত এক ঘটনা। যা আমি আজও ভুলতে পারিনি, কোনোদিন ভুলতেও পারবো না। যারা খাঁটি কমিউনিস্ট, তারা বোধহয় এমনই হয়ে থাকেন। এর নামই কি মানবতা? ‘মানুষ মানুষের জন্য’ স্লোগানের সার্থকতা?
প্রচার, যোগাযোগ ও অনুষ্ঠানের অর্থ যোগানোর ব্যাপারে খুবই পারদর্শিতা ছিলো কমরেড পুরঞ্জয় চক্রবর্তীর। সুবক্তাও ছিলেন। যে-কোনো সময় যে-কোনো স্থানে কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই বিষয় ও দর্শক-শ্রোতা উপযোগী বক্তব্য দিতে পারতেন। যে-কোনো বিষয়ে নিজে কথা কম বলে ধৈর্য ধরে শোনা ও বুঝার এবং উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে অদ্ভূত ধরনের এক ক্ষমতা ছিলো তাঁর। নতুন কর্মিদের সাথে দীর্ঘক্ষণ বসে ধৈর্য্যের সাথে আলাপ-আলোচনা করে কমিউনিস্ট পার্টি করার প্রয়োজনীয়তা বুঝাতেন। একবার তিনি অভিভাবক, নেতা ও সহযোদ্ধা, আবার তিনিই সাধারণ কর্মী। কঠোর-কোমলতার মিশেলে গড়া কমরেড পুরঞ্জয় নিয়মিত একতা পড়তেন, অন্যান্য বইপত্রও পড়তেন এবং বাসায় বা অফিসে যেয়ে তাঁর নির্দিষ্ট গ্রাহকদের কাছে নিয়মিতভাবে একতা পৌঁছিয়ে দিতেন ৩০-৪০ কপি প্রতি সপ্তায়। কোনো বিশেষ কারণে সময়মতো একতা পৌঁছাতে না পারলে আমার ডাক পড়তো। আমি সেই কাজটি বিনা বাক্য ব্যয়ে করে দিতাম পার্টিরই একটি কাজ মনে করে। একতা বিক্রির এ কাজটি তিনি চাকরিরত অবস্থায় এবং চাকরি শেষেও চালিয়ে গেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে অসুস্থ হয়ে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত। এরপর থেকে আমিই তাঁর বাসায় নিয়মিত একতা পৌঁছানোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। দেশিয় সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়েও সর্বদা সচেতন থাকতেন বাবলাদা, পর্যালোচনা করতেন, শেয়ার করতেন। বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর যখন বাসা থেকে খুব একটা বেরোতে পারতেন না, পত্রিকা-বই ঠিকমতো পড়তে পারতেন না; তখনও মোবাইলে অনেকক্ষণ ধরে রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে আমার সাথে আলাপ করতেন। মাঝে মাঝে আমিও তাঁর বাসায় যেয়ে আলাপ করতাম, পরামর্শ নিতাম। এতে তিনি খুব খুশি হতেন। আমাকে বলতেন, পার্টির বা গণসংগঠনের কোনো প্রোগ্রাম থাকলে নিয়ে যেতে, ডাক্তারের নিষেধ সত্বেও। কিন্তু আমি তো নিয়ে যেতে পারতাম না, তখন আমারো খুব খারাপ লাগতো। সব সময় বলতেন- লেগে থেকো, হতাশ হয়ো না, একদিন লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছাবো। এতো মানসিক শক্তি কোথা থেকে যে পেতেন, জানি না। যখন যে কাজ তিনি শুরু করতেন, সেটা যতো কঠিনই হোক না কেনো, তার শেষ না দেখে ছাড়তেন না। নব্বই এর দশকে যখন স্বার্থপর বিশ্বাসঘাতকরা হালুয়া-রুটির লোভে পার্টির আদর্শ পরিত্যাগ করে পার্টিকে বিলুপ্ত করার হীন চক্রান্ত করেছিলো, তখনও কমরেড পুরঞ্জয় দৃঢ়তার সাথে তাদের কুচক্রান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সিলেটে পার্টির পুনর্গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। পার্টির কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি অন্যান্য গণসংগঠনের কাজ, সাংস্কৃতিক সংগঠনে ব্যক্তিগত পারফরমেন্স, ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন ও ব্যাংক ইউনিয়নের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন, সাথে সাথে সাংসারিক কাজকর্মও সামাল দিয়েছেন সমান তালে। শুধু বিরল প্রতিভার অধিকারিরাই বোধ হয় এভাবে সকল কাজেই দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। ভুলিনি কমরেড, কোনোদিন ভুলবো না তোমায়।
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী সিলেটের সাথে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে কমরেড পুরঞ্জয় চক্রবর্তী জড়িত ছিলেন। ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে কুখ্যাত সামরিক শাসক আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের এক পর্যায়ে ১৯৬৮ সালে গড়ে উঠে প্রগতিশীল জাতীয় গণসাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। সেই উদীচী’র সিলেট শাখা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হলে তিনি তাতে যুক্ত হন এবং এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সাথে। নাট্যাভিনয়ে ছিলেন খুবই পারদর্শি। কমেডি কারেক্টার থেকে শুরু করে যে-কোনো কারেক্টারেই তাঁর ভরাট গলার অভিনয় দক্ষতা দর্শক-শ্রোতার প্রশংসা কুড়াতো। এছাড়াও সিলেট নগরীতে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন তিনি নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন এবং অনেক সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে নানা প্রতিকূল পরিবেশেও নিয়মিতভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সাহসী ভূমিকা রেখেছেন- যা নতুন প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয়। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য হিসবে শহীদ মিনার নির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কমরেড পুরঞ্জয় প্রথমে আগপাড়া এলাকায় “কিশোর সংঘ” নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। “ত্রিবেণী শিল্পী সংঘ” গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মিরাবাজারস্থ “নওজোয়ান ক্লাব”-এ তিনি অনেক নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ২০১০ সালে মিরাবাজার এলাকার ‘পুষ্পহাসি খেলাঘর আসর’ প্রযোজিত এবং সকলের শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব নাট্যজন ভবতোষ রায় বর্মণ রানা পরিচালিত নাটক “আম আঁটির ভেঁপু” হচ্ছে পুরঞ্জয় চক্রবর্তী অভিনীত শেষ নাটক। মিরাবাজারে “সোপান” নামক একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সহ-সভাপতি হিসেবে আজীবন দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
কমরেড পুরঞ্জয় চক্রবর্তী ‘সুরমা খেলাঘর আসর’ এর সাথেও দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে খেলাঘর সিলেট জেলা কমিটির সভাপতি হিসেবেও গুরুদায়িত্ব পালন করেন। খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির কাজেকর্মেও ছিলেন বিরামহীন। ব্যাংকের কাজকর্মেও কোনোদিন ফাঁকি দেননি; বরং একজন দক্ষ ব্যংকার হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭৩ সালে সোনালী ব্যাংক সিলেট শাখায় কাজে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর চাকরিজীবন শুরু হয়। ব্যাংকের মধ্যেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। সোনালী ব্যাংক এমপ্লয়ীজ ইউনিয়নে যুক্ত থেকে ‘সিবিএ’-এর বিভিন্ন পদে তিনি সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে ১৯৮১ সালে শিবানী শ্যাম চৌধুরীর সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর ছিলো সুখি সংসার। উচ্চ শিক্ষিত ছেলে একজন স্থপতী। মেয়েটিও পড়ালেখায় অত্যন্ত মেধাবী। ২০১০ সালের মার্চ মাসে সোনালী ব্যাংক খাদিমনগর শাখা থেকে পুরঞ্জয় চক্রবর্তী অবসরে যান এবং খেলাঘর ও কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্মে আরও বেশি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে থাকেন।
দীর্ঘদিন রোগভোগের পর গত ২৪ আগস্ট ২০২০ ইংরেজি ভোর সাড়ে চারটার দিকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কমরেড পুরঞ্জয় চক্রবর্তী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চলে যান না ফেরার দেশে।
লাল সালাম কমরেড পুরঞ্জয় চক্রবর্তী বাবলা। লাল সালাম।
লেখকঃ তুহিন কান্তি ধর, সম্পাদক, সিপিবি, শাহপরান থানা শাখা, সিলেট